বাতাসে পড়ে যাওয়া অভিনেতা ছেলেটিই তবে সেরা

বাতাসে পড়ে যাওয়া অভিনেতা ছেলেটিই তবে সেরা

বর্তমান বিশ্বের সেরা তিন ফুটবল তারকার কথা এলে সবার শেষেই উচ্চারিত হয় তার নাম। লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আর… নেইমার। রাশিয়া বিশ্বকাপে একই রাতে পতন ঘটেছে দুই মহাতারকার। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথমদিনই ফ্রান্সের গতির কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে মেসির আর্জেন্টিনা। উরুগুয়ের রক্ষণ প্রাচীরে আটকে গেছে ক্রিস্টিয়ানোর পর্তুগাল। বিশ্বকাপ থেকে ফেভারিটদের একের পর এক বিদায়ে নেইমারের ব্রাজিলকে নিয়েও ছিল সমূহ শঙ্কা।

উইং থেকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রমণে যায় ব্রাজিল। ইনজুরির কারণে তার এক স্তম্ভ দানি আলভেজ দলেই থাকতে পারেনি, আর গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচের শুরুতেই মাঠ ছেড়েছেন মার্সেলো। এই রকম একটি দলে খেলছেন নেইমার। বিশ্বের প্রধান তিন তারকার দুইজন বিদায় নিয়েছে সমর্থকদের চোখের জল ঝরিয়ে। আর্জেন্টিনা-পর্তুগালের বিদায়ে মেসি-ক্রিস্টিয়ানোর চেয়ে দোষারোপ করা হচ্ছে তাদের টিমমেটদের। কিন্তু নেইমার, অন্যপথের পথিক। সবাই যখন বাড়ির পথে তখন সে ছুটছে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের পানে।

গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে ট্যাকেলের শিকার হয়ে বারবার মাঠে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যগুলো নিন্দুকদের সহানুভূতি পায়নি। তারা বলেছিল, ছেলেটি বাতাসে পড়ে যায়। তার হেয়ার কাট নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন। কোস্টারিকার বিপক্ষে ডিবক্সে ফাউল আদায় করতে গিয়ে কার্ড দেখার বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে তার অপরাধী মানসিকতার পরিচয় হিসেবে। সার্বিয়ার সঙ্গে কড়া এক ট্যাকেলে কয়েকটি গড়ান খাওয়াকে ব্যঙ্গ করে বিজ্ঞাপন বানিয়েছে কেএফসি। তারা একবারও মনে রাখেনি, ২০১৪ সালে ফোর্টালিজা স্টেডিয়ামে কলম্বিয়ার জুনিগারের ফাউলে মেরুদ-ে আঘাত পেয়ে শেষ হয়েছিল ছেলেটির বিশ্বকাপ। তারা মনে রাখেনি, পায়ে অপারেশনের পর বিশ্বকাপের প্রাকমুহূর্তে সুযোগ হয়েছে মাঠে ফেরার। তারা মনেই রাখেনি, প্রথম ম্যাচেই সে শিকার হয়েছিল রেকর্ড সংখ্যক ১০টি ফাউলের। বারবার পড়ে যাওয়ার দৃশ্য নিন্দুকদের মুখে যে জোর দিচ্ছে সেখানেও সবার থেকে এগিয়ে নেইমার। রাশিয়া বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ২৩ বার ফাউলের শিকার হয়েছেন বাতাসে পড়ে যাওয়া ছেলেটি। অন্য দুই তারকা প্রতিপক্ষের কড়া মার্কিংয়ে থাকলেও তার বিরুদ্ধে এত বেশি পা চালাননি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা। তারপরও নিন্দুকদের চোখে কেবল তার শারীরিক দুর্বলতা, অভিনয়ই প্রধান হয়ে ধরা পড়ে, কৃতিত্ব নয়।

মাঠের নৈপুন্য কিন্তু বলছে অন্যকথা। বিশ্বকাপের আসরে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে ছাড়িয়ে গেছেন নেইমার জুনিয়র। বিশ্বাস হচ্ছে না? আসুন তাহলে, দেখে নিই প্রযুক্তির কাটাছেড়ায় প্রমাণিত পারফরম্যান্সের পরিসংখ্যান। রাশিয়া বিশ্বকাপে তিন তারকার মধ্যে প্রতিপক্ষের রক্ষণে সবচেয়ে বেশি (২৩টি) শট মেরেছেন নেইমার। ১২টি অনটার্গেট শটেও তিনিই এগিয়ে। চার বিশ্বকাপ খেলে ৬টি গোল করেছেন মেসি, আর সমান সংখ্যক বিশ্বকাপ খেলে ৮টি রোনালদো। দুই বিশ্বকাপে ইতিমধ্যে মেসিকে ছুয়েছেন আর রোনালদোকে ছাড়িয়ে যাবার অপেক্ষায় নেইমার। ক্লাব ফুটবলের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের মেসি-রোনালদো একটি গোলও পাননি বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে। সে গেরোও খুলেছেন নেইমার। তিন তারকার মধ্যে বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে কে বেশি কার্যকর? ৬ গোলের জন্য মেসিকে মারতে হয়েছে ৬৭ শট আর রোলানদোকে ৭৪। আর বাতাসে পড়ে যাওয়া ছেলেটি? দুই মহাতারকারই প্রায় অর্ধেক, মাত্র ৩৮টি। বিশ্বকাপে সমান ৬ গোল করতে লিওনেল মেসি খেলেছেন ১৭ ম্যাচ (১৮ ম্যাচের মধ্যে), রোনালদো খেলেছেন ১২ ম্যাচ (১৫ ম্যাচের মধ্যে) আর নেইমার মাত্র ৯ ম্যাচে সেটা অর্জন করেছেন। নেইমার স্বার্থপর নন, একা খেলেন না। সবাইকে নিয়ে টিমওয়ার্কে খেলেন এবং সুযোগ সৃষ্টি করে দেন সতীর্থদের। রাশিয়া বিশ্বকাপের চার ম্যাচে সতীর্থ জেসুস-কুতিনহোদের জন্য তিন তারকার চেয়ে বেশি সংখ্যক ১৬টি গোলের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। দ্বতিীয় রাউন্ডে নজিে এক গোল ও আরকে গোলে সহায়তা করে জতিে ননে ম্যান অব দা ম্যাচরে পুরস্কার।

খেলায় নান্দনিকতার প্রশ্ন তুলবেন? সে নন্দনবৃক্ষের উঁচু শাখায়ও বসে আসেন নেইমার। তার আক্রমণ রুঁখতে ধেয়ে আসা প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেন ড্রিবলিংয়ে। এই শৈল্পিকতায়-নন্দনেও তার কৃতিত্ব অন্যদের চেয়ে বেশি। রাশিয়া বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ৩৫টি সফল ড্রিবলিং করেছেন নেইমার। এ হিসাব নিখাদ পরিসংখ্যানের। কখনও বাতাসে রিসিভ করেছেন, কখনও প্রতিপক্ষের মাথার উপর দিয়ে কাটিয়ে নিয়েছে বল। তাহলে তিন তারকার মধ্যে বিশ্বকাপে কে সেরা? ক্লাব ফুটবলের দুই মহারাজাকে টেক্কা দিয়েছেন নেইমার। সবমিলিয়ে ভিনগ্রহের খেলোয়াড় খ্যাত মেসি আর গোলমেশিন খ্যাত রোনালদো অন্তত বিশ্বকাপে নেইমারের রেকর্ডের কাছে ম্লান। ছেলেটি কেবল বাতাসে পড়ে যায় না, পারফরম্যান্সের ঝড়ে প্রতিপক্ষকে উঁড়িয়েও দিতে পারে।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment